আমাদের ব্যস্ত জীবনে হাতে সময় নিয়ে পরিপাটি হয়ে ব্রেকফাস্ট করার সুযোগ আর মেলে কোথায়? তাই হাতের কাছে সহজেই যা পাওয়া যায় এমন জিনিসের উপর ভরসা করেই সারতে হয় সকালের নাস্তা। তখন তালিকায় সবার উপরে থাকে মাখন বা জেলি মাখিয়ে ময়দা আর পানির মিশ্রণে তৈরি অসাধারন জিনিসটি । ঝটপট বানিয়ে খেয়ে ফেলাও সহজ। বলুন তো কীসের কথা বলছি?
হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, বলছি পাউরুটির কথা। ব্রেকফাস্টের অন্যতম খাবার পাউরুটি। ময়দা, পানি, এবং ইস্ট বা অন্য লিভারিং এজেন্ট দিয়ে মিশ্রিত এবং বেক করা এক জনপ্রিয় খাবার। অথবা ময়দা এবং পানির একটি পেস্ট, যা তাপ দিয়ে রান্না করা হয়।
শুকনো পাউরুটি দিয়ে প্রতি ঘরে তৈরি হয় নানা ভিন্ন স্বাদের ভিন্ন রকমের পদ। অনেকে রুটির সাথে ডিম ভাজি দিয়ে খেতে বেশি পছন্দ করে। অনেকে পাউরুটি ডিম পোচ বা স্যান্ডউইচ করে খায়। কেউ কেউ কলা দিয়ে খায়। আবার কেউ কেউ শুধু পাউরুটি খায়। আপনি কীভাবে পাউরুটি খেতে পছন্দ করেন?
কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ উৎসের দিক দিয়ে পাউরুটি সারা বিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয়। বিভিন্ন দানা শস্যকে (গম, যব, বাজরা, ভুট্টা ইত্যাদি) গুড়িয়ে যে আটা বা ময়দা পাওয়া যায় তাই দিয়েই তৈরি হয় ভিন্ন রকমের পাউরুটি।
বাংলা ‘পাউরুটি’র নাম নিয়ে একটি মজার গল্প আছে। ধারণা করা হয় পাউরুটির তৈরির ময়দার খামির পা দিয়ে মাখানো হয় । তাই মানুষের মধ্যে একরকম একটা বিশ্বাস জন্মে যে পা দিয়ে ময়দা মাখানো হচ্ছে বলেই এর নাম ‘পাউরুটি’। কী হাস্যকর চিন্তা, তাই না! কিন্তু আসলে তা নয়, গল্পটা তাহলে খুলেই বলি।
পর্তুগিজরা বাংলার চট্টগ্রাম ও হুগলিতে তাদের বাণিজ্য কুঠি তৈরি করে। সাধারণ মানুষদের সাথে মেলামেশা বাড়তে থাকার সাথে সাথেই তাদের নানা রকম নতুন খাবারের সাথে পরিচিত হতে শুরু করি আমরা। Pau বা Pav বা Pao এই শব্দগুলো মূলত পর্তুগিজ শব্দ। যার অর্থ হচ্ছে ছোট গোল রুটি। তার মানে পাউরুটি আসলে পায়ের তৈরি রুটি নয়, এর মানে গোল রুটি । বুঝলেন তো! বাঙ্গালিরা এটাকে পাউন্ডের সংক্ষিপ্ত রূপে পাউ বলতো। আর তখন বাঙ্গালির হাতে বেলা চাপাতি রুটির সাথে পরিচয় ছিল, ধীরে ধীরে আমাদের প্রধান খাদ্য ভাতের পাশাপাশি পাউরুটি আমাদের খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে একটা জায়গা করে নিয়েছে।
পাউরুটির ইতিহাসের উপর গবেষণা অনুযায়ী, বিশ্বে প্রথম পাউরুটি মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে মিশরে, খ্রিস্টপূর্ব ৮০০০ বা তার কাছাকাছি সময়ে তৈরি করা হয়েছিল। মিশরীয় এই খাবার সারা পৃথিবীতেই জনপ্রিয়। শুরুর দিকে বেকাররা (Baker) জাঁতা নামক একটি সরঞ্জাম দিয়ে শস্য চূর্ণ করতো। তারপর তা থেকে রুটি উৎপাদন করতো। যার আকৃতি অনেকটা ভারতের চাপাটি কিংবা মেক্সিকোর টরটিলার মত ছিল।
এখন তো পাউরুটির কত ভাগ, কত নাম। সম্ভবত জার্মানি এমন এক দেশ যেখানে প্রায় তিনশো রকমের পাউরুটি রয়েছে! কাব্য, শিল্প, সাহিত্য, ধর্ম –প্রায় সব ক্ষেত্রেই যেন রুটি বা পাউরুটি বিরাজ করছে। এমনকি রুটির ইতিহাস ও প্রভাব নিয়ে আস্ত একটা মিউজিয়াম রয়েছে অস্ট্রিয়ায়, যার স্থাপত্যশৈলিও নজর কাড়ার মতো৷
অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় অবস্থিত সেই ব্রেড মিউজিয়াম!
সারা বিশ্বে, দেশগুলি তাদের নিজস্ব রুটির সংস্করণ তৈরি করেছিল। কেউ খামির দিয়ে , কেউ খামির ছাড়া। রোমানরা প্রায় ৪৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ওয়াটার-মিলিং উদ্ভাবন করে এবং পাউরুটিকে তারা শিল্প কর্মের পর্যায়ে নিয়ে যায়।
একইভাবে, ব্রিটিশ মধ্যযুগীয় সময়ে, পাউরুটি বেক করাও বেশ মর্যাদার প্রতীক হয়ে ওঠে। মজার ব্যাপার হল, ধনী এবং শিক্ষিত রোমানরা সাদা রুটিকে তাদের জন্য উচ্চমানের ও উপযুক্ত বলে মনে করত। তারা সাদা পাউরুটি খেতে পছন্দ করত, আর দরিদ্র মর্যাদার লোকদের জন্য রাই, চোঁকা এবং মোটা পাউরুটি রেখে দেওয়া হত।
সময়ের সাথে সাথে রুটিরও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে…
৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে ফরাসিরা শস্যকল করার জন্য একটি উইন্ডমিল সিস্টেম উদ্ভাবন করে এবং মেক্সিকানরা ১০০ খ্রিস্টপূর্বের দিকে প্রথম ভুট্টা টরটিলা তৈরি করে।
১৮৩৪ সালের কথা, সুইজারল্যান্ডে ইস্পাত রোলার মিলটি তখনও আবিষ্কৃত হয়নি। পাউরুটি বেকিং জগতে এই রোলার মিলটি বৈপ্লবিক আবিষ্কার ছিল। শস্য চূর্ণ করার পরিবর্তে, রোলার সিস্টেম শস্যের খোলস ভেঙে দেয়, যার ফলে এন্ডোস্পার্ম, জীবাণু এবং তুষ পৃথক করা সহজ হয়।
বিংশ শতাব্দীতে রাসায়নিক উপাদান সংযোজন করার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। ফলস্বরূপ পাউরুটি আরো সাদা আর নরম হয়ে যায় এবং অনেক বেশি সময় স্থায়ী হয়। ময়দাও ব্যাপকভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়েছিল এবং সরকার ময়দার সমৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য খনিজ এবং ভিটামিন ব্যবহারের প্রয়োগ শুরু করেছিল। ১৯৭০ এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এর ব্যবহার হ্রাস পায়। কিন্তু আবার এটি ১৯৮০র দশকে বেড়ে যায়। কিছু সংখ্যক বেকার পূর্বের মতো রাসায়নিক উপাদান ছাড়াই পাউরুটি তৈরী করার নিয়মে ফিরে যায়। তাদেরকে “শিকড়ে ফিরে যাওয়ার” জন্য এবং স্বাস্থ্যকর পাউরুটি উৎপাদনের জন্য নানা শ্রেণীর মানুষ ধন্যবাদ দেয়।
রুটি নিয়ে আকর্ষণীয় কিছু তথ্য:
- ১৬৬৬ সালের কথা, লন্ডনে একজন বেকারের জমি থেকে অগ্নিকান্ড শুরু হয় যা ৩ দিন ধরে জ্বলতে থাকে, যার ফলে শহরের ৪৩৬ একর জমি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। এই ঘটনাকে “গ্রেট ফায়ার” বলা হয়। কী ভয়ংকর!
- ফরাসি বিপ্লবের আগে “ময়দা যুদ্ধ” নামে একটি বিদ্রোহ সৃষ্টি হয়, কারণ তখনফ্রান্সে পাউরুটির মূল্য অতিরিক্ত মাত্রায় বাড়ানো হয়েছিল।
- দ্বাদশ শতাব্দীতে নাইট এবং লর্ড এর সময়কার কথা, ‘ট্রেঞ্চার্স’ নামের মোটা বা পুরু পাউরুটির টুকরো প্লেটের পরিবর্তে ব্যবহার করা হত। বোনাস হল কোন প্লেট ধোয়ার ঝামেলা ছিলো না, প্লেটটাই খেয়ে ফেলা যেতো। হা হা হা !!
- ইরেজার আবিষ্কার হওয়ার আগে লোকেরা পেন্সিলের চিহ্ন মুছতে নরম রুটির টুকরো ব্যবহার করত। কী বুদ্ধিই না ছিল তাদের!
আজকাল, আমরা যখন পাউরুটির কথা ভাবি, তখন আমাদের বেশিরভাগ ভোক্তাই গমের কথা ভাবেন। এটি কার্যত যে কোনো শস্য যেমন ভুট্টা, বার্লি, রাই, বাজরা, চাল এবং অমরন্থ থেকেও তৈরি করা যেতে পারে। এর সাথে ভালো পরিমাণ লবণ আর ইস্ট মেশালে এটা অনেক বেশি ফুলকো আর মচমচে হয়, এগুলো সহজপাচ্য আর সুন্দর ভাবে রান্নাও করা যায়।
পাউরুটির জনপ্রিয়তা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে বর্তমানে। অনেকেই স্বাদের চেয়ে পুষ্টিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। ব্রাউন ব্রেডে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে। এছাড়া ব্রাউন ব্রেডে ভিটামিন B6, ভিটামিন E, ম্যাগনেসিয়াম, ফলিক অ্যাসিড, জিঙ্ক, তামা এবং ম্যাঙ্গানিজ ইত্যাদি রয়েছে। ব্রাউন ব্রেডে দীর্ঘস্থায়ী অশ্বরোগ, ডায়াবেটিস, স্থুলত্ব এবং অন্যান্য হৃদরোগের ঝুঁকি কম থাকে।
লা ডেলিশিয়ার স্বাস্থ্যকর ব্রাউন ব্রেড অর্ডার করতে পারেন এখানে থেকেই। এই পর্যন্তই আমাদের আজকের “পাউরুটিকাহন” । খাদ্যজগতের আরও এমন জানা-অজানা কাহিনী জানতে আমাদের সাথেই থাকুন।