কেকের ইতিহাস এবং ইউরোপ | Le Delicia

কেকের ইতিহাস এবং ইউরোপ

কেকের পুঁথিপাঠ

‘কেক খেতে ভালো লাগে না’ –এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া সত্যিই কঠিন একটি কাজ হবে। বর্তমানে খুব কম মানুষই আছেন, যাদের কেক পছন্দ না। ছোট বাচ্চা, পূর্ণবয়স্ক বা বৃদ্ধ ব্যক্তি- সবার কাছেই এই কেক বেশ সুস্বাদু একটি খাবার হিসেবেই পরিচিত। ভ্যানিলা, চকলেট, স্ট্রবেরি, ব্ল্যাক ফরেস্ট, রেড ভেলভেট, বাটারস্কচ এবং আরও নানা ফ্লেভারের কেক দিয়ে সাজানো বিভিন্ন কেকের দোকান থেকে সহজেই আপনি বাছাই করে নিতে পারেন আপনার পছন্দের কেক। তাহলে আজকে বরং একটু ঘুরে আসা যাক, কেক আবিষ্কারের ইতিহাসের পাতায়।

কেকের ইতিহাস খুঁজতে হলে প্রাচীন পুঁথিপত্র উল্টেপাল্টে দেখতে হবে। বর্তমানে আমরা যে খাবারকে কেক বলে চিনি, শুরুতে তার রূপ ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম। সেগুলো দেখতে অনেকটা রুটির মত, আসলে গোড়ার দিকের কেকে পাউরুটির ভাবটা বেশি হলেও স্বাদ মিষ্টি করার জন্য এতে মধু ব্যবহার করা হতো। মাঝেমধ্যে একে আকর্ষণীয় ও আরো সুস্বাদু করার জন্য বাদাম ও ড্রাই ফ্রুটস মেশানো হতো।

খাদ্য ঐতিহাসিকদের মতানুসারে পৃথিবীতে প্রথম প্রাচীন মিশরীয়রাই কেক বানানোর পদ্ধতি রপ্ত করেছিল। ইংরেজি অক্সফোর্ড ডিকশনারি অনুযায়ী ত্রয়োদশ শতাব্দীতে কেক শব্দটি প্রকাশ্যে আসে। পুরনো নর্স (Norse) শব্দ ‘কাকা’ (Kaka) থেকে কেক শব্দের উৎপত্তি।

মধ্যযুগীয় ইউরোপে কেকঃ

মধ্যযুগীয় ইউরোপের বেকারিতে যে ফ্রুটকেক ও জিনজারব্রেড বানানো হতো, তা বহুমাস ভালো থাকত। আধুনিক কেক বলতে গোলাকার কেকগুলোকে বোঝানো হয়, যেগুলোর উপর আইসিং করা হয়।

খাদ্য গবেষকদের মতানুসারে, আজকের এই অত্যাধুনিক গোলাকার আইসিং কেকের প্রথম জন্ম হয় ইউরোপে। সময়টা ছিল সপ্তাদশ শতকের মাঝামাঝি । এর পেছনে মূলত ভূমিকা ছিল ইউরোপের প্রযুক্তিগত উন্নতির। এই উন্নতির কারণে ওভেন ও কেক বানানোর জন্য বিভিন্ন আকৃতির ছাঁচ আবিষ্কৃত হয়। তাছাড়া বিভিন্ন খাদ্য উপাদানও তখন সহজলভ্য হয়। ফলে কেক তৈরির কাজটি সহজ হয়ে যায়। কেকগুলোকে আকার দেওয়ার জন্য তখন শুধুমাত্র একধরনের ছাঁচই ব্যবহৃত হতো, যা তৈরি করা হতো ধাতু, কাগজ বা কাঠ দিয়ে। এগুলোর মধ্যে কিছু ছাঁচ নিয়ন্ত্রণযোগ্য ছিল। কখনো কখনো কেক প্যানও ব্যবহারের প্রচলন ছিল।

কেকের ওপর প্রথম আইসিং হিসাবে ব্যবহৃত হয় চিনি ও ডিমের সাদা অংশটির সাথে বিশেষ সুগন্ধি মিশিয়ে ফেটানো ফোমের মতো একটি মিশ্রণ দিয়ে। এটি এরপর কেকের ওপর ঢেলে দিয়ে অল্পকিছু সময়ের জন্য পুনরায় ওভেনে রাখা হতো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঠান্ডা হওয়ার পর কেকের আইসিং কভারটি বরফের মত চকচকে ও কঠিন হয়ে যেত। আইসিং দেওয়ার যুগেও কিছু কিছু কেকের উপর ড্রাই ফ্রুটস ব্যবহার করা হত।

কেকের মান আজকের পর্যায়ে আসে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। এই সময়ে কেক তৈরিতে ব্যবহৃত হতো ময়দা এবং ইস্টের বদলে বেকিং পাউডার। আর মনে করা হয়, এই সময়েই কেক নিজের বর্তমান রূপ পায়। বিশ শতক থেকেই পুরনো আইসিং পদ্ধতির বদলে বাটার, ক্রিম, পাওডার্ড চিনি বা আইসিং সুগার এবং বিভিন্ন ফ্লেভার ব্যবহার করে বাটারক্রিম তৈরি করে তার দ্বারা কেক সাজানো শুরু হয়।

ফ্রান্সের Antoine Careme [1784-1833]

 

ফ্রান্সের অ্যান্টোনি ক্যারিম কে আধুনিক পেস্ট্রি/কেকের বিশিষ্ট শেফ বলে মনে করা হয়। French Culinary ইতিহাস বইতেও তার সম্বন্ধে জানা যায় অনেক কথা। ফ্রান্সের বিখ্যাত গ্র‍্যান্ড কুজিনিকে তিনি দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক জাতীয় রূপ। তার হাত ধরেই এই বিশেষ ফ্রেঞ্চ রান্না পৌঁছে যায় এক অনন্য উচ্চতায়। ধারণা করা হয় তিনিই প্রথম সেলিব্রেটি পেস্ট্রি শেফ যার নাম ছিলো দুনিয়াজোড়া।

পরসমাচার

কেক, ব্রেড কিংবা বিস্কুট তৈরীতে খুব বেশি পার্থক্য না থাকায় সাধারণত ব্রেড বা রুটিকেই এদের জন্মদাতা বলা যেতে পারে। যদিও বেকিং ও ফার্মেন্টেশনের পদ্ধতি ও খাওয়ার পরিবর্তিত প্যাটার্নের ওপর ভিত্তি করে ব্রেডের নামকরণ করা হতো। কিছু রোমান ব্রেড আছে যা দেখতে কেকের মতই, যাতে ডিম আর বাটার ব্যবহৃত হয়। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার যেখানে ইউরোপীয় প্রভাব বেশি সেটিই কেকের প্রধান কেন্দ্রস্থল বলা যায়।

বহমান সভ্যতায় সবকিছুর মতই কেকও ক্রমশ জায়গা দখল করল পাশ্চাত্য থেকে এশিয়ার মাটিতে। জাপানে ছোট স্পঞ্জকেকগুলো Kasutera নামে পরিচিত ছিল। আবার ফিলিপাইন এর মুনকেক ও রাইসকেকও বেশ খ্যাতি অর্জন করে সেসময়।

সুইস হ্রদের গ্রামগুলোতে কেক তৈরীর উপকরণ হিসাবে অসমানভাবে ভাঙা দানাশস্য ব্যবহৃত হতো। সেগুলিকে জমিয়ে গরম পাথরের ওপর রেখে বেক করা হতো।

উনিশ শতকে কেক তৈরীর পদ্ধতিতে নতুন দিগন্ত খুলে যায়। ১৮৪০সালে বেকিং পাউডারের আবিষ্কার কেক তৈরীকে আরও সহজ করে দেয়। ফলে ইস্টের ব্যবহার বেশ অনেকটা কমে যায়। কেক তৈরী করা আরও সহজ হয়ে যায় তাপমাত্রা পরিবর্তনশীল ওভেনের আবিষ্কার এর মাধ্যমে।

উত্তর-পশ্চিম ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় একসময় বাড়িতেই নিত্যনতুন কেক প্রস্তুতির প্রণালী আবিষ্কার হতে থাকে। প্রধানত বাড়িতে গৃহকর্ত্রীদের দ্বারাই এসব বিস্ময় জাগানো কেকের আবিষ্কার হয়। এই কেক তৈরীতে তারা বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। বিংশ শতকের দিকে বিশেষ করে কোন অনুষ্ঠানে বা অতিথি আপ্যায়নে এই কেকের বিকল্পে তেমন আর কিছু ছিল না। এখনও বিবাহ বা জন্মদিনের মত শুভ অনুষ্ঠানে কেক বানানোর প্রচলন আছে। এমনকি এখন কেক ছাড়া আমরা কোনো উৎসব পালন করার কথা চিন্তাও করতে পারি না।

কেকের ইতিহাস নিয়ে জানতে গিয়ে নানান কেকের ছবি ও রেসিপি দেখেছি। তাই এবার মনে মনে বেশ ছকে নিয়েছি কোন কেকটা বাড়িতে বানানো যাক। আর যাই হোক চকোলাভা কেক, ফ্রুট কেক, অরেঞ্জ কেক, পাইন্যাপেল কেক, ব্লাক ফরেস্টসহ আরো নানান কেক বাড়িতে সহজেই বানানো যেতেই পারে। আর তা না হলে কেক শপ তো রইল নিজেদের ঠিকানায়, কী বলেন?

 2797 Views  0 Comments
`
  • No products in the cart.